| ০৭ জুন ২০২৫

দ. এশিয়ার রক্তাক্ত সীমান্ত তোয়াক্কা না করে প্রেম-বিয়েতে কারা এগিয়ে, ঘোর বিরোধী কে

রিপোর্টারের নামঃ ডেস্ক নিউজ
  • আপডেট টাইম : 25-05-2025 ইং
  • 10020 বার পঠিত
দ. এশিয়ার রক্তাক্ত সীমান্ত তোয়াক্কা না করে প্রেম-বিয়েতে কারা এগিয়ে, ঘোর বিরোধী কে
ছবির ক্যাপশন: দ. এশিয়ার রক্তাক্ত সীমান্ত তোয়াক্কা না করে প্রেম-বিয়েতে কারা এগিয়ে, ঘোর বিরোধী কে

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ নিয়ে গঠিত দক্ষিণ এশিয়া যা ভারত উপমহাদেশ নামেও পরিচিত। মূলত সাংস্কৃতিক-ভাষাগত মেলবন্ধন ও ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল এটি। এই অঞ্চলে ভূরাজনীতিক দ্বন্দ্ব, সীমান্ত সংঘাত, জাতীয়তাবাদের উত্তাপ-উম্মাদনা, ধর্মীয় দাঙ্গা-হানাহানি থাকলেও যুগে যুগে প্রেম-ভালোবাসা সেইসব বিভাজন-সংঘাতকে টপকে আন্তঃসীমান্ত বিয়ের পাশাপাশি আন্তঃধর্ম বিয়ের মাধ্যমে এক অনন্য মানবিক সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয় এই অঞ্চলে এমন সীমান্তজয়ী বিয়ের প্রবণতার পেছনে কী সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন বেশি কাজ করে নাকি অন্য কিছু। ইতোমধ্যে অনেকেরই হয়তো জানতে ইচ্ছা করছে এই অনবদ্য ভালোবাসাকে ঠিক কারা চিরবৈরিতায় রূপ দিতে মরিয়া। 

আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি পর্যায়ের একাধিক গবেষণা ও সংবাদ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি আন্তঃসীমান্ত বিয়ে হয় বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে ভারতীয় নারী-পুরুষের। বিশেষত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, সিলেট ও খুলনা অঞ্চলের বাসিন্দাদের বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। মূলত ভাষাগত (বাংলা) মিলের পাশাপাশি ধর্ম-উপাসনা, খাদ্যাভ্যাস ও সাহিত্য সংস্কৃতির গভীর মিল এই সম্পর্ককে কাঁটাতারের বাধা উপেক্ষা করার মনোবল যুগিয়েছে।

নেপাল ও ভারতের মধ্যে উন্মুক্ত সীমান্ত থাকার কারণে বিহার ও উত্তর প্রদেশ রাজ্যের সঙ্গে নেপালের তেরাই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে বিয়ের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ভাষা, ধর্মীয় রীতি আর পারিবারিক নিয়মের মিল থাকায় মৈথিলি, ভোজপুরি আর হিন্দি ভাষাভাষীদের সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ হয়েছে। মৈথিলি, ভোজপুরি, হিন্দি ভাষার অঞ্চলগুলো মূলত ভারতের উত্তর ও পূর্ব দিকে বিস্তৃত, আর লাহোর ও পাঞ্জাবের মতো জায়গাগুলো আজকের পাকিস্তানের অংশ হলেও একসময় এই সব অঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ভাষাগত ও পারিবারিক রীতিনীতিতে গভীর মিল ছিল। বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসনের আগে ও শুরুর দিকে, এমনকি ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার আগ পর্যন্ত, দিল্লি, লাহোর আর পাঞ্জাব ছিল একে অপরের সঙ্গে নানা দিক থেকে জড়িত।

এইসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের চলাফেরা, বিবাহসূত্রে সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ধর্মীয় উৎসবের রীতিনীতি খুব স্বাভাবিক ছিল। ফলে রাজনৈতিক সীমারেখা তৈরির আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সংযোগ বা বন্ধন গড়ে উঠেছিল, যা এতটাই গভীর ছিল যে তা অনেকদিন ধরে, এমনকি ব্রিটিশ ভারত ভাগের পরেও কিছুটা সময় পর্যন্ত সম্পর্ক ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল।

ভারত–পাকিস্তানের প্রেমিক যুগলদের প্রসঙ্গ আসলে দেখা যায়, শোয়েব মালিক ও সানিয়া মির্জার মতো কিছু আলোচিত ও হাই-প্রোফাইল আন্তঃসীমান্ত বিয়ে হয়েছে। তবে ২০০০ সালের পর থেকে রাজনৈতিক বৈরিতা ও কড়া ভিসা নীতির কারণে এসব বিয়ের হার কমে যায়। 

ভারতীয়দের সঙ্গে ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের তরুণ-তরুণীর বিয়ের হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও কিছু আবেগী সম্পর্ক বিশেষত ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও পর্যটকদের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে হয়েছে। তবে ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘ সীমান্তঘেঁষা চীনের নাগরিকের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার এই সাত দেশের তরুণ-তরুণীর আন্তঃবিয়ের খতিয়ান নেই বললেই চলে। চীনে পড়াশোনা বা ব্যবসা করতে গিয়ে কিছু ভারতীয়, নেপালি এবং বাংলাদেশি নাগরিক সেখানে বিয়ে করলেও তাতে নিখাঁদ ভালোবাসা এবং মনস্তাত্বিক সংযোগের চেয়ে সাময়িক প্রয়োজনই প্রাধান্য পায়।

বিশ্বব্যাংকের অভিবাসন-সংক্রান্ত তথ্যাবলী এবং পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে অভিবাসনের ৩৫ শতাংশ হয়েছে বিয়ের মাধ্যমে। অনুমান করা যায়, এই ২০ বছরে ৫ লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে অভিবাসন করেছেন। এর ৩৫ শতাংশ বা আনুমানিক ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ এসময় বিয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অভিবাসন করেছেন। অন্যদিকে, ভারত থেকে বাংলাদেশে অভিবাসনের ঘটনাও ঘটেছে, তবে এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম এবং এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

নেপাল থেকে ভারতে অভিবাসনের ৪০ শতাংশের বেশি হয়েছে পারিবারিক পুনর্মিলনের কারণে। এদিকে, পাকিস্তান থেকে ভারতে বিয়ের কারণে আসার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম (৫ শতাংশের নিচে), যা ভিসা কঠোরতা ও রাজনৈতিক বৈরিতার প্রতিফলন। চীন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রেম-ঘটিত বিয়ের কারণে স্থায়ী অভিবাসন এক শতাংশেরও কম।

প্রেমের শক্ত ভিত্তির মূলে কী: দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃসীমান্ত বিয়ে অনেকাংশেই সম্ভব হয়েছে সংস্কৃতির মেলবন্ধন, ভাষাগত মিল, ধর্মীয় এবং পারিবারিক রীতিনীতির সামঞ্জস্যের কারণে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, বাংলা নাটক ও সাহিত্য-গল্প-উপন্যাস ভালোবাসার একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। নেপাল ও ভারতের ক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের ধারণা ও সংস্কৃতি, হিন্দু রীতি অনুযায়ী বিয়ে ও আর্থ-সামাজিক শ্রেণির মিল এই যুগলদের সম্পর্ককে টেকসই করেছে। সিনেমা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আন্তঃদেশীয় পরিচয়-প্রেমে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। 

তবে যেখানে সীমান্তের কাঁটাতার, পাসপোর্ট, ভিসা ও আইনি জটিলতা ভালোবাসাকে বাধা দেয়, সেখানেই প্রেম অদম্য শক্তিতে এগিয়ে চলে। ভিসা প্রক্রিয়া কঠিন হওয়ায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয় ও সামাজিক চাপ অনেক সময় এমন বিয়েতে জটিলতা সৃষ্টি করে। কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত সন্দেহে আন্তঃসীমান্ত দম্পতিদের পর্যবেক্ষণের মুখে পড়তে হয়।

কারা এর ঘোর বিরোধী: গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বর্ণবৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থায় প্রেম ও বিয়ে কেবল ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয় না থেকে হয়ে উঠেছে জাতিগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও পারিবারিক বিরোধের কারণ। দুই দেশের সীমান্তের কাঁটাতারের মতোই বহু মানুষের মানসিকতা জুড়ে রয়েছে বিভাজন-দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষবাষ্প। বিশেষত ভারত ও পাকিস্তান, কিংবা বাংলাদেশ ও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত প্রেম বা বিয়ের ক্ষেত্রে সমাজের একাংশের তীব্র আপত্তি লক্ষ্য করা যায়।

প্রথমত, এই সব দেশের নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনেক সময় এই ধরনের আন্তঃদেশীয় সম্পর্ককে সন্দেহের চোখে দেখে। প্রেম নয়, এটি ‘স্ট্র্যাটেজিক রিক্রুটমেন্ট (কৌশলগত নিয়োগ)’ বা ‘ইনফরমেশন এক্সচেঞ্জ (তথ্যের আদান-প্রদান)’-এর অজুহাত হতে পারে—এমন সন্দেহের জন্ম দেয় কখনো কখনো।

দ্বিতীয়ত, কট্টরপন্থি এবং ধর্মভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী, যারা জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে এবং একে একধরনের পবিত্র আবেগ হিসেবে ধারণ করে, তারাই এসব প্রেম-বিয়েকে ‘জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেও তকমা দেয়া অপচেষ্টা করে।

তৃতীয়ত, পারিবারিক স্তরে বহু পরিবার এখনও সীমান্তপারের প্রেম-বিয়ে মানতে নারাজ, বিশেষত ধর্মীয় বা ভাষাগত পার্থক্য থাকলে। এই গোঁড়ামির পেছনে ইন্ধন দিয়েছে আগেকার যুদ্ধ-সংঘাত, বিভাজন এবং পারস্পরিক সন্দেহের ঘৃণিত ইতিহাস।

সবশেষে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় কিছু উগ্রজাতীয়তাবাদী নেটিজেন বরাবরই এই ধরনের সম্পর্কের বিরোধিতা করে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ছড়ায়, যা কখনো কখনো এমন জঘন্য ভাষায় রূপ নেয় যে, তা প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়। 

ভারতীয় লেখক ও শান্তিবিষয়ক গবেষক ড. অশোক রায় বলেন, ‘ভাষা, ধর্ম বা রাজনীতি একসময় মানুষের মনে বিভাজনের সীমারেখা টেনে দেয়, কিন্তু হৃদয়ের সংযোগ যদি গভীর হয়, তা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। আন্তঃসীমান্ত বিয়ে তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।’

পাকিস্তানি মানবাধিকার কর্মী মারিয়া জাফর বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক যতই শত্রুতার আবরণে ঢেকে থাকুক, ভালোবাসা এবং মানুষের সংবেদনশীল হৃদয় সবসময় আলো খোঁজে। বিয়ে সেই পথের সেতুবন্ধন।’

দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃসীমান্ত বিয়েগুলো শুধু ব্যক্তিগত প্রেমের গল্প নয়- এদের মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রতিবেশী দেশের বাসিন্দাদের ঐক্য, মানবতা এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থানের সম্ভাবনা। সীমান্ত মানে শুধু ভৌগোলিক বিভাজন নয় তা মানসিক ও সামাজিক বিভক্তির প্রতীকও। তাই যারা এই সীমান্তকে উপেক্ষা করে ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যায়, তাদের সাহস যেমন অনন্য, তেমনি যারা এর বিরোধিতা করছেন, তাদের প্রতিবন্ধকতাও সমাজের গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র যদি এই সম্পর্কগুলোকে সংকট হিসেবে না দেখে, বরং সাংস্কৃতিক কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তবে এক নতুন দক্ষিণ এশিয়ার সূচনা হতে পারে, যেখানে সীমান্ত থাকবে কেবল মানচিত্রে, হৃদয়ে নয়। 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
নামাজের সময়সূচী
জাতীয় সঙ্গীত
©সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ Gen Z Bangladesh Online - জেন জি বাংলাদেশ অনলাইন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ