স্মৃতির পাতায় এখনো সজীব হয়ে আছে সেই সব দিন, যখন পৃথিবীর প্রতিটি কোণ নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। ২০২০ ও ২০২১ সাল যেন মানবসভ্যতার এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামের কালপর্ব। হাসপাতালের করিডোরজুড়ে কান্না, শ্বাসনালির যন্ত্রণা আর মৃত্যুর হিসাব যেন প্রতিদিনের রোজনামচা হয়ে উঠেছিল। করোনা, এক নামেই কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল সভ্যতার হৃৎপিণ্ডে। আবার ফিরে এসেছে নতুন রূপে।
কোভিড-১৯-এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট (যা আগের ভাইরাস থেকে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে তৈরি হয়) আবার আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এই নতুন শত্রু আগের মতোই নিষ্ঠুর, শুধু তার ছদ্মবেশটি ভিন্ন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয়, ইতোমধ্যেই তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে। ভারতের দিল্লি, মহারাষ্ট্র, কেরালা প্রভৃতি অঞ্চলে নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্টের (ওমিক্রন LF.7, XFG, XFC, JN.1 এবং NB.1.8.1) সংক্রমণ হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। এপ্রিলের শুরু থেকেই একেক দিনে গড়ে সাত হাজারের বেশি আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়, যার মধ্যে বেশির ভাগই নতুন উপভেরিয়েন্টের শিকার। মৃত্যুও থেমে নেই—প্রতিদিন প্রায় ২৫ থেকে ৪০ জনের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। নেপালেও একই সময়ে সংক্রমণের হার ২০ শতাংশ ছুঁয়েছে, যদিও সে দেশে পরীক্ষার হার কম, তবু সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ভুটান ও মালদ্বীপে তুলনামূলকভাবে আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও সতর্ক অবস্থানে আছে দেশ দুটি। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত সতর্কতা এবং স্থানীয় লকডাউনের মতো ব্যবস্থা নতুন করে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সংক্রমণ ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এপ্রিল মাসে একটি কেস, মে মাসে ৫০টি, জুনে প্রথম দুই সপ্তাহে সংক্রমণ ছিল আরো বেশি, মৃত্যুর সংখ্যা ৩। মৃত্যুহার তুলনামূলক কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নতুন ভ্যারিয়েন্টের এক ধরনের ‘সাইলেন্ট ওয়েভ’, যা সংখ্যায় কম হলেও গভীরতায় বিপজ্জনক।
নতুন ভ্যারিয়েন্টটির উপসর্গগুলো কিছুটা পরিবর্তিত। আগের মতো শ্বাসকষ্ট ও হঠাৎ জ্বর প্রধান নয়; বরং এখন দেখা যাচ্ছে গলাব্যথা, মাথা ঘোরা, দুর্বলতা এবং হালকা কাশি। কেউ কেউ অভিজ্ঞতা করছেন স্বাদ-গন্ধ চলে যাওয়া, আবার কারো ক্ষেত্রে শুধু সামান্য ঠান্ডাজনিত অনুভূতি। শিশুদের মধ্যে জ্বর-খুসখুসে কাশি ও পাতলা পায়খানা লক্ষণীয়। একটি উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে—অনেকেই উপসর্গহীন থেকেও ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নতুন ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেছে। তাদের মতে, এই নতুন স্ট্রেইন হয়তো আগের চেয়ে সংক্রমণযোগ্য এবং সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা বেশি।
বাংলাদেশের জাতীয় উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, আইসিডিডিআর’বি বলছে, ‘নতুন ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত ছড়ায়, কিন্তু সবসময় গুরুতর উপসর্গ তৈরি করে না বলে অনেকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না—এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা।’
অদৃশ্য শত্রুর নিঃশব্দ পদচারণা সর্বত্র—আকাশপথে, জলপথে ও সীমান্তে। বিমানবন্দর আর বন্দর যেন আজ আমাদের প্রথম প্রহরী। প্রবেশমুখে কঠোর স্ক্রিনিং, নিখুঁত নজরদারি—এটাই এখন সময়ের দাবি। স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম যেন হয়ে ওঠে প্রতিটি নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যাস। সতর্ক থাকলে—বাঁচা যায়; অবহেলায়—হারিয়ে যেতে পারে একটি পুরো শহর। এই পরিস্থিতিতে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ জনগণকে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার, ভিড় এড়ানো এবং হাত ধোয়ার নিয়মে অভ্যস্ত হতে হবে।
মিডিয়াকে সত্যনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল প্রতিবেদন পরিবেশন করতে হবে, যাতে গুজব ও ভীতি ছড়িয়ে না পড়ে। সরকারের উচিত যথাসময়ে তথ্য প্রকাশ, টিকাদান কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিতকরণ এবং স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। একত্রে সবাইকে এক কণ্ঠে বলতে হবে—জীবনকে রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম।
এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট হয়তো আগের মতোই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন, কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা এখন অনেক বড় সম্পদ। আমরা জানি কীভাবে বাঁচতে হয়, কীভাবে লড়াই করতে হয়। শুধু ভয় নয়, দরকার প্রস্তুতি। ভয়াবহ অতীতের ছায়া নতুন রূপে ফিরে এলেও, আমাদের সাহস, সংযম ও সচেতনতার আগুনে তা নিঃশেষ হতেই বাধ্য।
অন্ধকারে আলো খুঁজে পাওয়ার নামই সভ্যতা। আর আজ আবার সেই আলো খুঁজে নিতে হবে আমাদের—নতুন আশার, নতুন জীবনের, নতুন ভোরের আলো।
ফজর | ০৪:৫৪-০৬:০৮ মিনিট ভোর |
---|---|
যোহর | ১২:০৯-০৪:২৫ মিনিট দুপুর |
আছর | ০৪:২৬-০৬:০৬ মিনিট বিকাল |
মাগরিব | ০৬:১০-০৭:২১ মিনিট সন্ধ্যা |
এশা | ০৭:২২-০৮:৪৯ মিনিট রাত |
জুম্মা | ১.৩০ মিনিট দুপুর |