| ০৭ জুন ২০২৫

দক্ষিণে রুট পারমিট জটিলতায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার: পদ্মা সেতু দিয়ে চলছে হাজারো অবৈধ বাস

রিপোর্টারের নামঃ ডেস্ক নিউজ
  • আপডেট টাইম : 24-05-2025 ইং
  • 11239 বার পঠিত
দক্ষিণে রুট পারমিট জটিলতায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার: পদ্মা সেতু দিয়ে চলছে হাজারো অবৈধ বাস
ছবির ক্যাপশন: দক্ষিণে রুট পারমিট জটিলতায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার: পদ্মা সেতু দিয়ে চলছে হাজারো অবৈধ বাস

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই সেতুটি ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বিভিন্ন রুটে বৈধ রুট পারমিট থাকা বাসের সঙ্গে চলাচল করছে রুট পারমিট না থাকা হাজারো বাস। একটি প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে এসব বাস চলাচল করায় যথাযথ ফি পরিশোধ করে রুট পারমিট নেওয়া পরিবহনের মালিকরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তেমনি সরকারও কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।

জানা গেছে, রুট পারমিট না থাকা এসব বাসকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বিগত সরকারের আমলে পরিবহন মালিকরা রুট পারমিট নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র ও বাস রুট রেশনালাইজেশনের তৎকালীন সভাপতি শেখ ফজলে নূর তাপসের সিদ্ধান্তে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সে সময় বাস রুট রেশনালাইজেশন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিআরটিএকে রুট পারমিট বন্ধের চিঠি দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে চিঠি দিয়েছে, যা চলতি সপ্তাহেই মন্ত্রণালয়ের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিএসসিসি ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী-পোস্তগোলা রুটে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে আন্তঃজেলা গাড়ির রুট পারমিট বন্ধের অনুরোধ জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ ২০ সেপ্টেম্বর ডিএসসিসিকে একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় চলাচলকারী আন্তঃজেলা বাসের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এ রুটে পারমিটের জন্য আড়াই হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে। এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে ডিএসসিসির দিকনির্দেশনা চাওয়া হলেও ডিএসসিসি কোনো উত্তর দেয়নি।

পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর বিআরটিএ এক চিঠিতে সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানালে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, বাস্তবতার নিরিখে পদ্মা সেতুতে চলাচলকারী রুট পারমিটবিহীন বাস বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহার না করার শর্তে রুট পারমিট দেওয়া যেতে পারে মর্মে ডিএসসিসিকে জানানো যেতে পারে। মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিআরটিএকে অনুরোধ জানানো হয়। এ নির্দেশের ভিত্তিতে বিআরটিএ ২০২২ সালের ২ নভেম্বর ও ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ জরুরি ভিত্তিতে মতামত চেয়ে ডিএসসিসিকে দুটি চিঠি দিলেও ডিএসসিসি কোনো উত্তর দেয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্লাহ ব্যক্তিগত স্বার্থে যোগসাজশ করে পদ্মা সেতুতে বাস চলাচলের রুট পারমিট বন্ধের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। বাস রুট রেশনালাইজেশন সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে বিআরটিএকে রুট পারমিট বন্ধের চিঠি দেওয়া হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় তাপসকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। ফলে এ রুটে অবৈধভাবে ম্যানেজের মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার পরিবহন চলাচল করছে।

এ বিষয়ে শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের আগেই তিনি দেশত্যাগ করেছেন এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি আর দেশে ফেরেননি। এ ছাড়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সঙ্গেও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, মানুষের চাহিদা আছে বলেই পরিবহন মালিকরা অবৈধভাবে এসব রুটে বাস চালাচ্ছেন। একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ অথবা সমন্বয়হীনতার কারণেই বাসের পারমিট দিতে সংকট দেখা দিয়েছে। জনস্বার্থে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করে বাসের রুট পারমিট প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত। এতে একদিকে যাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধা বাড়বে, অন্যদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে।

এদিকে আন্তঃজেলা বাসের রুট পারমিট দেওয়ার জন্য ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। এ কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে আছে বিআরটিএ। তবে ডিএসসিসি চিঠি দেওয়ার পর বাসের রুট পারমিট প্রদানের জন্য গঠিত কমিটির বৈঠক বন্ধ রয়েছে।

বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শুধু ঢাকা-বরিশাল রুটে মোট ১ হাজার ৪০৭টি বাস চলাচলের জন্য রুট পারমিট দেওয়া হয়। এরপর ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের আপত্তির কারণে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ৬০টি বাস ছাড়া অন্য কোনো বাসের রুট পারমিট দেওয়া হয়নি। তৎকালীন সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ওই ৬০টি বাসের রুট পারমিট নেন।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচলে রুট পারমিট বন্ধ করে রাখা অনভিপ্রেত। এর ফলে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর একটি মহলকে ম্যানেজ করে পদ্মা সেতু দিয়ে অবৈধভাবে পরিবহন চলাচল করছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে এ ব্যাপারে বিআরটিএকে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথোপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এর ফলে বৈধ রুট পারমিট নিয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে এবং সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে।’

রুট পারমিটের আবেদন করা লাবিবা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সামছুল হক লিটন বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য রুট পারমিটের আবেদন করে দীর্ঘদিনেও অনুমতি মেলেনি। যার ফলে তাদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের কাছে সুরাহা চাইলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তৎকালীন মহাসচিব এনায়েত উল্লাহর নিষেধ থাকায় আপাতত এ রুটে কোনো বাসের রুট পারমিট দেওয়া সম্ভব নয়।

গ্রিন লাইন পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার বলেন, আগে শুধু ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-বরিশাল ও ঢাকা-বেনাপোল রুটে পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে গ্রিন লাইন পরিবহন চলাচল করত। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর এ সার্ভিস আরও বাড়াতে কোম্পানি ৩০ কোটি টাকা দিয়ে আরও ২০টি বিলাসবহুল বাস চলাচলের জন্য প্রস্তুত করে। কিন্তু পদ্মা সেতু দিয়ে রুট পারমিটের জটিলতায় চাহিদা অনুযায়ী বাস চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে একদিকে পরিবহন মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।

জানতে চাইলে বিআরটিএ পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং ও রোড সেফটি) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি চলাচলে যানজট বৃদ্ধির আশঙ্কা জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস একটি চিঠির মাধ্যমে পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচলের রুট পারমিট বন্ধ রাখার জন্য বলেছিলেন। তবে বিষয়টি পর্যালোচনাধীন রয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচলের উপযুক্ত সংখ্যক গাড়িকে রুট পারমিট দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু উদ্বোধনকালে দিনে ২৩ হাজার ৯৫৪টি যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা ছিল। এ সক্ষমতা ২০৩০ সালে ৩৬ হাজার ৭৮৫টিতে উন্নীত হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমানে পদ্মা সেতু দিয়ে দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করছে এবং প্রায় সোয়া ২ কোটি টাকা টোল আদায় হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হলে যানবাহনের চাপ বাড়বে—এমন পূর্বাভাস মাথায় রেখে ঢাকার জন্য ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় কিছু প্রকল্পের সুপারিশ করা হলেও, তার বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
নামাজের সময়সূচী
জাতীয় সঙ্গীত
©সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ Gen Z Bangladesh Online - জেন জি বাংলাদেশ অনলাইন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ