নিদারুণ দুঃসময়ে একটি আশ্বাসবাণীও মানুষের কাছে আরাধ্যের মতো মনে হয়। এই আশ্বাসবাণী মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, উদ্দীপ্ত করে, উদ্বুদ্ধ করে। যখন মানুষ হতাশার সাগরে হাবুডুবু খায়, তখন একটি অভয়বাণী মানুষকে প্রেরণা দেয়, আশার আলো দেখায়। ঠিক সেই রকম একটি বক্তব্য পাওয়া গেল গত বুধবার।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনানিবাসে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে অফিসার্স অ্যাড্রেসে এমন আশ্বাসের কথা শোনান। সেনাপ্রধানের বক্তব্য জনমনে এনেছে বিপুল স্বস্তি, সাহস। উৎকণ্ঠিত বাংলাদেশ যেন অন্ধকার টানেলে আলোর সন্ধান পেয়েছে সেনাপ্রধানের বক্তব্যে।
আমাদের সেনাবাহিনী জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, সার্বভৌমত্বের প্রতীক।
বিভিন্ন সংকটে, দুর্যোগে সেনাবাহিনী বারবার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে, জনগণকে সহায়তা দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী আমাদের প্রধান ভরসাস্থল। সেই সেনাবাহিনী আবার জনগণকে আশ্বস্ত করল। জুলাই বিপ্লবের সময় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশকে একটি অনিবার্য গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছে।
সেনাবাহিনীর দৃঢ় অবস্থানের কারণে একটি স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। এখন যখন দেশে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা, দেশ যখন অরাজকতার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে, দেশকে নিয়ে যখন চলছে নানা রকম দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, ঠিক সেই সময় সেনাপ্রধানের বক্তব্য যেন জাতির কাছে এক টনিক হয়ে দেখা দিল।
সেনাপ্রধানের প্রতিটি বক্তব্য যেন জনগণের মনের কথা। জনগণ যা ভাবছে, জনগণ যা চাইছে, সেটাই যেন বললেন সেনাপ্রধান। তিনি যেন জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করলেন।
সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘যথাসম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা প্রয়োজন।’
এটি শুধু সেনাপ্রধানের বক্তব্য নয়, সব মানুষের মনের কথা। দেশের সব মানুষ চায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ধার। আর সে কারণেই সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের ফলে জনগণের মধ্যে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। সবাই মনে করছে, যত ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত এ বছরের শেষ নাগাদ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সেনাবাহিনী যে অঙ্গীকার করেছে, তা নিশ্চিত করা হবে। কারণ বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। এ কারণেই সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের এত আস্থা।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে। তিনি বলেছেন, ‘সার্বিকভাবে দেশে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনসহ সব সংস্থা ভেঙে পড়েছে, পুনর্গঠিত হতে পারছে না।’
এটিও জনগণের মনের কথা। গত ৯ মাসে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কথায় কথায় রাজপথ অবরোধ, বিভিন্ন আন্দোলনের নামে জনভোগান্তি চরম সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। জনগণ আর নিতে পারছে না। এ রকম একটি বাস্তবতায় সেনাপ্রধান যেন মানুষের হৃদয়ের কথা বলেছেন। তিনিই যেন জনগণের কণ্ঠস্বর। অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, সেই বিষয়টি সামনে এনে সেনাপ্রধান যেন ‘জাতির বিবেক’ ও ‘জাতির কণ্ঠস্বর’ হলেন। এর ফলে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি মানুষের আশা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় বিষয়টি ছিল সেনাবাহিনীর সম্পর্কে অপপ্রচার এবং গুজব। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সেনাবাহিনীর অক্লান্ত এবং নিঃস্বার্থ ভূমিকা সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানকে টার্গেট করা হচ্ছে, যা হতাশাজনক।’ এটিও জনগণের মনের কথা।
আমরা লক্ষ করেছি, আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, আমাদের গৌরবের, অহংকারের সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তি মনগড়া, ভিত্তিহীন, মিথ্যা, অযৌক্তিক কথাবার্তা বলছেন; বুঝে না বুঝে সেনাবাহিনী সম্পর্কে গুজব ছড়াচ্ছেন। সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে অনেকেই দেশের সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এ ধরনের গুজব যে দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতার জন্য ক্ষতিকর, সে বিষয়টি জনগণ বুঝতে পেরেছে। এবার সেনাপ্রধান আনুষ্ঠানিকভাবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। আমরা প্রত্যাশা করি, এর ফলে সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য থেকে সবাই বিরত থাকবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি সুস্পষ্টভাবে রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডরের ব্যাপারে ‘না’ বলেছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘মানবিক করিডরের মতো স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই। শুধু একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’ তিনি বলেন, “করিডরের ব্যাপারে সরকার কী ভাবছে অথবা জাতিকে একটি ‘প্রক্সি ওয়ার’-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছে কি না—এ বিষয়ে সরকার স্পষ্টভাবে কিছু জানাচ্ছে না।”
করিডরের ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘দেয়ার উইল বি নো করিডর।’ তাঁর এই বক্তব্য যেন দেশপ্রেমিক কোটি বাঙালির কণ্ঠস্বর। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী যে আমাদের অখণ্ডতার প্রতীক, আমাদের দেশ রক্ষার যে অতন্দ্র প্রহরী, সেটি তাঁর বক্তব্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণ হলো। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রতি ইঞ্চি মাটি রক্ত দিয়ে কেনা। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও কাউকে দেওয়া যাবে না এবং বাংলাদেশকে কখনোই যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যাবে না—সেনাপ্রধানের এই উপলব্ধি এ দেশের প্রতিটি মানুষকে আশ্বস্ত করেছে, করেছে গর্বিত। এর ফলে মানবিক করিডর নিয়ে বাংলাদেশের যে অনিশ্চয়তা, ঝুঁকি এবং এটা নিয়ে লুকোচুরি—তার অবসান হবে বলে সবাই আশা করেন।
তাঁর এই বক্তব্যের পর আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার করিডরের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। একটি নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে। একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়েও সেনাপ্রধান সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী আমাদের ভূখণ্ডের রক্ষক এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।’
সেনাপ্রধানের আরেকটি বক্তব্যও জনগণের মনের কথা। সংস্কার প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘কী সংস্কার হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে—এ নিয়ে আমার কিছু জানা নেই।’ তিনি জানান, এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা আলোচনা করা হয়নি। জনগণকে যেমন অন্ধকারে রেখে কিছু সুশীল জনগণের কথা বলে তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত কিছু ভাবনা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তেমনি সশস্ত্র বাহিনীকেও এর বাইরে রাখা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের ভেতরেই যে গলদ, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সেনাপ্রধান।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ এখন শুধু একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এই কাজটি অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত শুরু করবে—এটাই সবাই আশা করে। বিশেষ করে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর এ বিষয়ে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয় বলে সবাই মনে করে।
জনগণের মনের ভেতর যে কথাগুলো ছিল, সেই কথাগুলো সেনাপ্রধান উচ্চারণ করে পুরো জনগণের মধ্যে একটা গুমোট অবস্থার অবসান ঘটালেন। এই সাহসী উচ্চারণ এই কঠিন সময়ে মানুষকে পথ দেখাবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস বেড়ে যাবে। এই একটি বক্তব্য যেন এই সময়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করল, মানুষকে ভাবতে শেখাল যে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। এই অন্যায়-অবিচার ও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর। সশস্ত্র বাহিনী যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব তারা নেবে। জনগণের পাশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সব সময় যে থাকে, আছে এবং থাকবে, তা আবার প্রমাণ করলেন আমাদের সেনাপ্রধান। ধন্যবাদ সেনাপ্রধান, এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, মানুষের মনের কথাগুলো উচ্চারণ করার জন্য এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আপনার অঙ্গীকারের জন্য। জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী যে সব সময় নির্ভীক, সাহসী, অকুতোভয়—সেটি আবার প্রমাণ হলো।
ফজর | ০৪:৫৪-০৬:০৮ মিনিট ভোর |
---|---|
যোহর | ১২:০৯-০৪:২৫ মিনিট দুপুর |
আছর | ০৪:২৬-০৬:০৬ মিনিট বিকাল |
মাগরিব | ০৬:১০-০৭:২১ মিনিট সন্ধ্যা |
এশা | ০৭:২২-০৮:৪৯ মিনিট রাত |
জুম্মা | ১.৩০ মিনিট দুপুর |