| ০৭ জুন ২০২৫

দেড় দশকে ঢাকায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে

  • আপডেট টাইম : 10-05-2025 ইং
  • 33789 বার পঠিত
দেড় দশকে ঢাকায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে
ছবির ক্যাপশন: দেড় দশকে ঢাকায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে

ডেস্ক নিউজ: 

দেশের প্রায় সবক’টি জেলায় বইছে তাপপ্রবাহ। গতকাল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডঙ্গায়, ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও রেকর্ড হয়েছে ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রার বড় একটা অংশ ভূমি শোষণ করে নেয়। এতে গরমের অনুভূতি অনেকটাই কমে আসে। কিন্তু অতি নগরায়ণের প্রভাবে ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর ভূমির তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলছে। গত দেড় দশকে ঢাকার ভূমির তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যে কারণে পারদে রেকর্ড হওয়ার তাপমাত্রার চেয়েও ঢাকায় গরম অনুভূতির মাত্রা অনেক বেশি থাকে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, এর আগে চলতি বছরে দুইদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২৮ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় এবং ২৩ এপ্রিল যশোরে ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গতকাল রেকর্ড করা হয়েছে ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে ২৮ মার্চ রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বৃহস্পতিবারের তুলনায় গতকাল তাপপ্রবাহ দেশের আরো বেশি এলাকায় ছড়িয়েছে। এ অবস্থা আরো অন্তত দুইদিন থাকতে পারে। বৃষ্টি না হলে তাপপ্রবাহ কমার তেমন লক্ষণ নেই। গতকাল ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও ময়মনসিংহের প্রায় সর্বত্র তাপপ্রবাহ ছিল। এর আগের দিন চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে তাপপ্রবাহ অপেক্ষাকৃত কম ছিল। এসব এলাকার বেশির ভাগ স্থানে তাপপ্রবাহের বিস্তার ঘটে গতকাল।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, তাপপ্রবাহের পরিধি অনেকটাই বেড়ে গেছে। এ অবস্থা অন্তত আরো দুইদিন চলতে পারে। তবে এমন পরিস্থিতি এ মাসের জন্য খুব অস্বাভাবিক নয়।

দেশের উষ্ণতম মাস এপ্রিল এবার ততটা উষ্ণ ছিল না। চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহেও তাপমাত্রা মোটামুটি সহনীয় ছিল। কিন্তু গত বুধবার থেকে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। এ মাসে এত গরম কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেছেন, এ তাপমাত্রা মে মাসে একেবারে অস্বাভাবিক না। বৃষ্টি কমে গেলেই তাপমাত্রা বাড়ে। এপ্রিলে গরম অপেক্ষাকৃত কম ছিল, কারণ পশ্চিমা লঘুচাপ সক্রিয় থাকার কারণে ওই মাসে মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাব আপাতত নেই। দুই-তিনদিন পর পশ্চিমা বায়ু আবার সক্রিয় হবে। তার প্রভাবে বৃষ্টি বাড়তে পারে।

ঢাকাসহ দেশের পাঁচটি বড় শহরে তাপমাত্রার ঝুঁকি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে গত বছর। যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসসহ (বিইউপি) সরকারের দুটি সংস্থা মিলে গবেষণাটি পরিচালনা করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটের নগর এলাকার তাপমাত্রাগত ঝুঁকি নিয়ে গবেষণাটি করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, পাঁচটি শহরেই নগর এলাকায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নগর এলাকার আশপাশে বা বাইরের এলাকা থেকে অনেক বেশি। পাঁচটি শহরের মধ্যে তুলনামূলক বেশি ঝুঁকি ঢাকার নগর এলাকার। এখানে ২০০৫-১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড় দশকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর চট্টগ্রামে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

গবেষণায় বলা হয়েছে, অতি নগরায়ণের ফলে দেশের বড় শহরগুলোয় কংক্রিটের আচ্ছাদন বেড়েছে। নগর এলাকার বাইরে তুলনামূলক গরম কম থাকে। কিন্তু নগর এলাকায় তাপমাত্রা থাকে বেশি। নগর এলাকার অপ্রতুল ভূমি সূর্যের উত্তাপে তেতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, নগরীতে কংক্রিটের যত অবকাঠোমো আছে সেগুলোয়ও তাপ এসে জমা হয়। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর জমা হওয়া তাপের কারণে দিনের মতো রাতেও গরম অনুভূত হতে থাকে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রতুল পানির আধার, বৃক্ষ নিধন আর কংক্রিটের আচ্ছাদনের কারণে ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলো পরিণত হয়েছে আরবান হিট আইল্যান্ডে। ফলে নগরীর তাপমাত্রা ৩৪-৩৬ ডিগ্রি থাকলেও তার অনুভূতি ৪০-৪২ ডিগ্রিতে গিয়ে পৌঁছে। যে কারণে গরমের মৌসুমে এ নগরীর তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। বিভিন্ন এলাকায় পানিরও তীব্র সংকট তৈরি হয়। বাড়ে রোগ-বালাইয়ের প্রবণতাও।

ঢাকাসহ দেশের নগর এলাকা থেকে বৃক্ষের আচ্ছাদন ও জলাশয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে এসব এলাকার ভূমি তুলনামূলক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘‌সূর্যের তাপ শোষণ করার জন্য একটি নগরে পর্যাপ্ত মাটি ও জলাধার থাকা প্রয়োজন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশির ভাগ এলাকাই এখন কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে তাপ শোষণের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া এসব এলাকায় প্রচুর যানবাহন এবং শিল্প-কারখানা সক্রিয় থাকে। নানা কারণেই ঢাকার মাটি ও বাতাসে তাপ জমা হয়ে উত্তপ্ত থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেশি করে গাছ লাগানো ও জলাধারের পরিমাণ বৃদ্ধির বিকল্প নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখানে সমস্যা যেটা হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের নগর এলাকায় মানবঘটিত কারণে গরমের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। বিশেষ করে ইটভাটা, অত্যধিক কলকারখানা, আনফিট যানবাহন, বাসাবাড়ি ও অফিস-আদালতে এসির সংখ্যা বৃদ্ধি, উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের কারণে তীব্র বায়ুদূষণ, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে বর্জ্য পোড়ানো—এসবই গরমের অনুভূতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তাপমাত্রা হয়তো আগের চেয়ে অল্প বেড়েছে, কিন্তু গরমের অনুভূতি ৫-৭ ডিগ্রির মতো বেশি মনে হয়। এজন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ করাসহ টেকসই উদ্যোগ না নিলে আগামী দিনগুলোয় মরুভূমির গরম অনুভূত হবে।’

বৈশ্বিক তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাকার তাপমাত্রাও বাড়ছে। তবে মানবঘটিত কারণে ঢাকার মাটি ও বাতাস যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে তা সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। এতে আমাদের দেশেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমরা যেভাবে নগরে কংক্রিটের আচ্ছাদন দিয়েছি, তাতে তাপমাত্রাকে সহনশীল রাখার চেষ্টা না করে আমরা তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছি। ঢাকা শহরে তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণ মূলত অতিমাত্রায় কংক্রিটের আচ্ছাদন। সেই সঙ্গে সবুজ, জলাশয় ও গণপরিসর কমে আসাও দায়ী। তাপমাত্রা মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্য আর দীর্ঘমেয়াদে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা পরিকল্পনা করছি রাজধানীতে গাছের আধিক্য কীভাবে বাড়ানো যায়। তবে এ তাপপ্রবাহ সমস্যার স্বল্পমেয়াদি কোনো সমাধান নেই। রাজধানীর ক্ষেত্রে মধ্যম মেয়াদি সমাধান হলো ঢাকাকে সবুজায়ন করা আর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো বিকেন্দ্রীকরণ, যেটার নীতিগত সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।’

দেশে সবচেয়ে বেশি গরম থাকে এপ্রিলে। এর গড় তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মে মাস হলো দেশের দ্বিতীয় উষ্ণতম মাস। এ সময় গড় তাপমাত্রা থাকে ৩২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তা মাঝারি তাপপ্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়। তাপমাত্রা ৪২-এর বেশি হলে তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে গণ্য হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
নামাজের সময়সূচী
জাতীয় সঙ্গীত
©সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ Gen Z Bangladesh Online - জেন জি বাংলাদেশ অনলাইন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ