| ০৭ জুন ২০২৫

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ৩৫ লাখ শিশু

  • আপডেট টাইম : 01-05-2025 ইং
  • 44144 বার পঠিত
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ৩৫ লাখ শিশু
ছবির ক্যাপশন: ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ৩৫ লাখ শিশু

ডেস্ক নিউজ: 

রাজধানীর রমনা পার্কে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করে শিশু হৃদয় ইসলাম (৮)। পার্কে প্রতিদিন সকাল ৮টায় ঢুকে, বের হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। পার্কের বাইরে ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ দোকানে দুপুরের খাবার সেরে নেয়। খাওয়া শেষ হতেই আবার কর্মে ফিরে যায়।

প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা চা বিক্রির কাজ করে হৃদয়। শিশুটির উপার্জনের টাকায় মা আর বোনের মুখে খাবার জোটে। মিরপুর-১০ নম্বর এলাকার একটি হোটেলে কাজ করে ইব্রাহিম (১১)। কাজে আসে সকাল ৯টায়, কাজ শেষে বাড়ি ফিরে রাত ১০টায়। সেখানে খাবার পরিবেশন, টেবিল মোছা, বাসন, গ্লাস, বাটি ধোয়ার কাজ করে ইব্রাহিম। তিন বেলা খাবার হোটেলেই খায়। মাসে বেতন তিন হাজার টাকা। ঢাকার লালমাটিয়ার এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে রমিছা (১২)। সকাল ৬টায় কাজ শুরু, শেষ হয় রাত ১২টায়। প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা তাকে কাজ করতে হয়। রমিছার মতো বাসাবাড়িতে বহু মেয়ে শিশু গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দিনভর পরিশ্রম করেও অনেক শিশুর ভালো খাবার এবং ঘুমের জন্য আরামদায়ক বিছানা জোটে না। অনেকেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।

দেশে শিশুশ্রম বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম প্রতিবেদন মতে বর্তমানে কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার। যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। প্রতিবেদন মতে, ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত। যা ২০১৩ সালে ছিল ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। তবে প্রতিবেদনে বলা হয় দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের হার কমেছে।

২০২২ সালের শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী ১০ লাখ ৬৮ হাজার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম জড়িত। যা ২০১৩ সালে ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার। ‘শিশুশ্রম জরিপ ২০২২’ জরিপে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, ৫-১৭ বছর বয়সি শিশু ৩ কোটি ৯৯ লাখ, কর্মজীবী শিশু ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন, শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। শিশুশ্রম জরিপ ২০২৩ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু। শিশুশ্রমিকের প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস। পেটের দায়ে, সংসার চালাতে দরিদ্র বাবা-মাকে সাহায্য করতে ওরা শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। ১৪ বছরের কম বয়সি ছেলে বা মেয়েকে গৃহকাজের শ্রমে নিয়োগ না করতে হাইকোর্টের রায় থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

২০১৫ সালে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হলেও সেটাকে আইনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। বাসায় যে শিশুরা কাজ করে, তাদের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকাভুক্ত করা দরকার উল্লেখ করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সমন্বয়কারী সাফিয়া সামি বলেন, ২০১৫ সালে করা নীতিমালা আইনে পরিণত করা এবং শিশুদের বিষয়টি আলাদা করে উল্লেখ রাখা জরুরি। উন্নয়নকর্মীদের ঘোষণা দিতে হয় যে, তারা বাসায় কোনো শিশু শ্রমিক রাখতে পারবে না। সরকারি চাকুরেদের ক্ষেত্রেও সেই নিয়ম করলে অর্ধেক অনাচার-নির্যাতন কমে আসবে। অনেকেই বলেন, শিশুরা ঘরে নিরাপদে থাকার সুযোগ পায়। ‘আমাদের গবেষণা ভিন্ন কথা বলে। এই শিশুরা বাসায় যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়। ২০২৩ সালে শ্রম আইন সংশোধন করা হলেও তাতে গৃহশ্রমিকদের কথা উল্লেখ করা হয়নি। শ্রমিকের মর্যাদা না থাকায় তারা কোনো সুযোগ সুবিধাই পায় না।

রাজধানীতে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। আর ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ গৃহকর্মী অত্যধিক কাজের চাপে থাকে। অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) পরিচালিত ‘সিচুয়েশন অব চাইল্ড ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইন ঢাকা সিটি’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। এএসডির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইউকেএম ফারহানা সুলতানা জানান, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ১২টি থানা এলাকায় এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। ৩৫২ জন গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু এই জরিপে অংশ নেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতনের শিকার শিশুদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ শারীরিক আঘাতের শিকার। মারধরের শিকার ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ, বকাঝকার শিকার ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহকর্মীদের ৬৭ শতাংশ মানসিক নির্যাতন, ৬১ শতাংশ মৌখিক এবং ২১ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঘটে মৃত্যুর ঘটনাও। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রীতি উরাং নামের ১৫ বছর বয়সি এক গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনা আলোচনার জন্ম দেয়। প্রীতির মৃত্যুর ছয় মাস আগে একই বাসা থেকে পালাতে গিয়ে আহত হয় ৯ বছরের ফেরদৌসী। মামলা করা হলেও অভিযুক্ত আশফাকুল হক ফেরদৌসীর চিকিৎসার খরচ আর দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে সেই মামলা থেকে অব্যাহতি পান। অথচ ফেরদৌসী এখনো ঠিকমতো হাঁটাচলা বা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না।

ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে শিশুর সংখ্যা ছয় কোটিরও বেশি। ৯০ শতাংশ প্রাথমিকভাবে স্কুলে গেলেও শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই অর্ধেকের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। বিশ্বখাদ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ শিশুশ্রম দিচ্ছে শুধু খাদ্যের বিনিময়ে। ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুকে মজুরি দেওয়া হলেও এর পরিমাণ শিশু আইনের তুলনায় নগণ্য।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ৪৫ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে। এর মধ্যে ৪১ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ থাকে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এক সমীক্ষায় ৭০৯টি কারখানার মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, মোট ৯ হাজার ১৯৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩ হাজার ৮২০ শিশু। এই শিশুশ্রমিকদের অধিকাংশেরই বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই মানা হচ্ছে না শ্রম আইন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুকে শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহারে ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ শিশুরা প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে উপবৃত্তি পাবে। উপবৃত্তির এ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে দেওয়া হবে। এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে শুধু এই এক লাখ শিশুকে প্রত্যাহারই নয়, এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করা হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমাদের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ’-এর ১২তম সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হয়। গ্রাম-গঞ্জে ইটভাটাসহ বিভিন্ন সেক্টরে শিশুশ্রম বেশি পরিলক্ষিত হয়। যা কখনো কাম্য নয়। বর্তমান সরকার সব সেক্টরে শিশুশ্রম নিরসনে বদ্ধপরিকর।

অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এএসডির নির্বাহী কমিটির সভাপতি ড. আলতাফ হোসেন বলেন, দেশে শিশুদের সুরক্ষার জন্য নীতিমালা থাকলে হবে না। এই নীতিমালা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন না করা গেলে কোনো ধরনের কাজই হবে না। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও তার যথার্থ প্রয়োগ নেই। ফলে আইন অমান্য করে মালিকপক্ষ অনেক কম বেতনে শিশুশ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে। দেশ থেকে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ’ কাজ করছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
নামাজের সময়সূচী
জাতীয় সঙ্গীত
©সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ Gen Z Bangladesh Online - জেন জি বাংলাদেশ অনলাইন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ