| ০৭ জুন ২০২৫

তবুও আশায় বুক বাঁধছেন খুলনার পাটশ্রমিকরা!

  • আপডেট টাইম : 01-05-2025 ইং
  • 44095 বার পঠিত
তবুও আশায় বুক বাঁধছেন খুলনার পাটশ্রমিকরা!
ছবির ক্যাপশন: তবুও আশায় বুক বাঁধছেন খুলনার পাটশ্রমিকরা!

ডেস্ক নিউজ: 

এক সময়ের শিল্পনগরী খুলনার খালিশপুর এখন শুধুই স্মৃতির শহর। একের পর এক পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। যারা এক সময় ঘড়ি ধরে মিলগেটে যেতেন কাজের আশায়, তারা এখন দিনমজুর, রিকশাচালক কিংবা পুরোপুরি বেকার। ভাগ্যবিড়ম্বিত এ মানুষগুলো আজও মিলগেটের সামনে এসে দাঁড়ান, যদি আবার চালু হয় কারখানা, যদি ফিরে আসে কর্মজীবন।

৪৫ বছর বয়সী আবুল হাওলাদার ছিলেন খালিশপুর জুট মিলে কর্মরত। প্রায় ১৬ বছর সেখানে শ্রম দিয়েছেন। পরিবারের মুখে হাসি ছিল, সন্তানদের ভবিষ্যৎ ছিল নির্ভরতার। কিন্তু ২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকল একযোগে বন্ধ করে দেয়ার পর সেই নিশ্চয়তার ভিত্তি ভেঙে পড়ে। এখন তিনি খণ্ডকালীন দিনমজুরের কাজ করেন—সপ্তাহে দুই-তিন দিন কাজ পেলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন।

মিল নিয়ে নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবুল হাওলাদার বলেন, ‘খালিশপুর জুট মিলে যখন কাজ করতাম, সকালবেলা বাঁশি বাজলেই লাইন ধরে আমরা মিলের ভেতর ঢুকতাম। কাজ ছিল, সম্মান ছিল, সপ্তাহ শেষে বৃহস্পতিবার ছিল বেতনের দিন, মানে আমাদের খুশির দিন। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতাম, বাজারে দামাদামি করতে হতো না। এখন সকাল হলে মনে হয়—কোথায় যাব? কোন কাজে যাব? সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে থেকেও কাজ পাই না। মাঝে মাঝে মনে হয়—আমরা কী ভুল করেছিলাম?’

আবুল হাওলাদারের মতো একই অবস্থা খুলনা অঞ্চলের আরও অন্তত ২০ হাজার পাটশ্রমিকের। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, লোকসানের কারণ দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। এতে চাকরি হারান স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক। রুগ্ন হয়ে পড়ে শিল্পাঞ্চল। কর্মসংস্থান হারানো মানুষগুলোকে কোনো ধরনের বিকল্প ব্যবস্থার নিশ্চয়তা ছাড়াই ফেলে রাখা হয়।

শ্রমিকদের জীবনে এখন শুধুই অনিশ্চয়তা, হতাশা আর টিকে থাকার লড়াই। এক সময়ের কর্মব্যস্ত মিল এলাকার শ্রমিকরা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে—কেউ রিকশা চালান, কেউ হেলপার, কেউ গৃহকর্মী। চোখে মুখে ক্লান্তি আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা। তারা চান, মিলগুলো পুনরায় চালু হোক, ফিরুক জীবনের গতিময়তা।

প্লাটিনাম পাটকলের সাবেক শ্রমিক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মিল যখন চলত, তিন বেলা খেতে পারতাম, বাচ্চাদের স্কুলে দিতে পারতাম। এখন গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করি, কিন্তু সংসার আর চলে না। কবে আবার সেই দিনের আলো দেখব জানি না। সরকার যদি একটু আমাদের কথা ভাবত, হয়তো জীবনটা এমন হত না।’

দীর্ঘ ১২ বছর খালিশপুর জুট মিলে কাজ করা নারী শ্রমিক রাশিদা খাতুন বলেন, ‘মেয়ের মুখ চেয়ে শিফটে কাজ করতাম। মিল বন্ধ হওয়ার পর বাসাবাড়িতে কাজ করছি, কিন্তু সংসার চলে না। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু সামর্থ্য নেই। সরকার যদি একটু সাহায্য করত, আবার যদি মিল চালু হতো, তাহলে আমাদের মতো অসহায় মানুষগুলো বাঁচার সুযোগ পেত।’

একজন শ্রমিক নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা চাই, দ্রুত মিলগুলো সরকারিভাবে চালু করা হোক। তালিকা করে পুরোনো শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। 

বন্ধ হয়ে যাওয়া ৯ পাটকলের মধ্যে চারটি বেসরকারি উদ্যোগে চালু হলেও তা চলছে সক্ষমতার এক চতুর্থাংশে, আর চাকরি হয়েছে সর্বসাকুল্যে হাজার দুয়েক শ্রমিকের। চালু হওয়া মিলগুলো হলো দৌলতপুর জুটি মিল, জেজেআই জুট মিল, স্টার জুট মিল আর কার্পেটিং জুট মিল।

অবশ্য, বিজেএমসি (বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন) দাবি করছে, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে এসব মিল ইজারার ভিত্তিতে বেসরকারি খাতে চালু করা হবে। ইতিমধ্যে চারটি মিল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আংশিকভাবে চালু হয়েছে, তবে সেখানে কাজ পেয়েছেন সর্বোচ্চ ২ হাজার শ্রমিক।

বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয় কর্মকর্তা মো. গোলাম রাব্বানি বলেন, ‘আমরা আশাবাদী যে ধাপে ধাপে মিলগুলো চালু হবে এবং এতে নতুন করে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বাড়বে।’

তবে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে আশার কথা শুনতে শুনতে মানুষগুলোর বুক এখন প্রায় শূন্য। যুগ্ম আহ্বায়ক মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘মিলগুলো বন্ধ হওয়ার পর থেকে হাজারো শ্রমিক পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ, পরিবারে চিকিৎসার অভাব—সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় দুর্দশা।’

রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোর বাইরে গত এক দশকে আরও অন্তত পাঁচটি বেসরকারি পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে খুলনা অঞ্চলে। শুধু পাটশিল্প নয়, এক সময়ের গর্ব ‘নিউজপ্রিন্ট মিল’, ‘হার্ডবোর্ড ফ্যাক্টরি’, ‘টেক্সটাইল মিল’, ‘দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি’—সবই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এর প্রভাবে ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে পড়েছে খুলনার অর্থনীতি।

তবুও শ্রমিকদের চোখে এখনও আশার আলো। তারা চান, সরকার দ্রুত এবং কার্যকর উদ্যোগ নেবে মিলগুলো আবার চালু করার, যাতে পুনরায় কর্মমুখর হয়ে ওঠে এই জনপদ। তারা চান তাদের সন্তানরা আবার শিল্পাঞ্চলের নতুন ভোর দেখুক—নতুন জীবনের আশায় বুক বাঁধেন তারা, প্রতিদিন।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
নামাজের সময়সূচী
জাতীয় সঙ্গীত
©সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ Gen Z Bangladesh Online - জেন জি বাংলাদেশ অনলাইন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ