ডেস্ক নিউজ:
দিনের ঢাকা কিংবা রাতের, মূল সড়ক অথবা অলিগলি, এমনকি ফ্লাইওভার— সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। রাজধানীর বাইরেও বিভিন্ন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত চলাচল করা লাখ লাখ এ যানবাহনের কোনো ধরনের বৈধতা নেই।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাটারি অটোরিকশা বানাতে দেওয়া হলেও কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনেনি। এখন ঢাকার রাস্তা ছেয়ে গেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, দ্রুত গতির এই বাহন বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনা, বাড়াচ্ছে হতাহতের সংখ্যা, সৃষ্টি করছে যানজট।
শুরু থেকে বিশেষজ্ঞরা ব্যাটারি অটো রিকশা নামতে না দেওয়া, পরে নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও তাতে কান দেওয়া হয়নি। সরকার উল্টো আন্দোলনের মুখে বলেছে, চলতে দেওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। বর্তমানে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে তা চলতে থাকলে ঢাকাসহ জনবহুল শহরগুলো আর বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না বলে সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারতসহ একাধিক দেশ থেকে ব্যাটারিচালিত প্রযুক্তির অটোরিকশা বাংলাদেশে নামতে শুরু করে। তখন থ্রি হুইলার নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা বিদ্যমান থাকলেও নতুনভাবে রাস্তায় নামা অটোরিকশা নিয়েও উদাসীন ছিল তৎকালীন সরকার। ফলে হু হু করে বাড়তে থাকে ব্যাটারির রিকশা। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সরকারকে বারবার সতর্ক করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি।
এই অটোরিকশার কারণে দুর্ঘটনা, হতাহত ও যানজট ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি উঠতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ১৫ মে সড়কে ব্যাটারিচালিত বন্ধের ঘোষণা দেন তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী পলাতক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু চালকদের বিক্ষোভের মুখে তখন পিছু হটে সরকার। গত বছরের ২০ মে মন্ত্রিসভার অনির্ধারিত আলোচনায় শেখ হাসিনা ব্যাটারি রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়েছেন বলে রাজনৈতিক এক কর্মসূচিতে জানান মন্ত্রী কাদের। তবে ২২টি মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানান তিনি।
ব্যাটারি রিকশা চলাচলের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায় বৃহত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন রিকশা মালিক ঐক্য জোট। তাদের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৯ নভেম্বর সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে তিন দিনের মধ্যে ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে এসব যানবাহনের কার্যক্রম বন্ধে তাদের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা ব্যাখ্যা করতে রুল জারি করা হয়। এর বিরুদ্ধে ব্যাটারি রিকশার চালকরা রাস্তা অবরোধ করে নৈরাজ সৃষ্টি করে। এর পেছনে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ঢাকা অচলের চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৫ নভেম্বর ব্যাটারি রিকশা বন্ধে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দেয় চেম্বার আদালত। ফলে ব্যাটারি রিকশা চলাচল চলতে থাকে এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা-সমালোচনাও অব্যাহত থাকে।
গত কয়েক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ব্যাটারিচালিত রিকশা অন্যতম দায়ী বলে একের পর এক প্রতিবেদনে বলে আসছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা চলাচল নিষিদ্ধের পাশাপাশি এর যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধের দাবি সংগঠনটির। দেশে ব্যাটারি রিকশার সংখ্যা কত, তা কেউ বলতে পারছে না। তবে এই সংখ্যাটা সারা দেশে ৪০-৫০ লাখ আর ঢাকায় ৮-১০ লাখের মতো বলে ধারণা করা হয়। বিপুলসংখ্যক হওয়ায় এসব রিকশা বন্ধ না করে লাইসেন্স ও রুট পারমিট দিয়ে নীতিমালা করে নিয়ন্ত্রণের কথাও বলছেন চালক ও তাদের সংগঠনের নেতারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্মেরও আগে থেকে ঢাকায় প্যাডেল রিকশা চলাচল করছে। তবে রিকশার সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় নব্বইর দশকে তা নিয়ন্ত্রণে লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তাতে রিকশার বিস্তার ঠেকানো যায়নি। এটি যানজট বৃদ্ধির কারণ হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ব্যাটারি রিকশার মহামারি।
ফলে প্যাডেল রিকশার কদর ও উপার্জন কমে যাওয়ায় অনেক চালক এখন ব্যাটারি রিকশা চালাচ্ছেন। আবার অনেক নতুন চালক এই যানটি চালাচ্ছেন, তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ কিশোর বা কম বয়সি। দ্রুত গতির হওয়ায় ব্যাটারি রিকশায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে, তাতে হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। অন্য যানবাহনকে সাইড না দেওয়া এবং আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। যানটির সংখ্যা মহামারি আকার ধারণ করায় যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে আবার মূল সড়কেও দাপিয়ে বেড়ানোয় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ছোট গাড়ি যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। সড়কে ছোট গাড়ির সংখ্যা বাড়াতে চালকের সংখ্যাও বেড়েছে। ফলে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সড়ক দখল করে ফেলছে, বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। এখন বিজ্ঞানসম্মতভাবে যানজট, দুর্ঘটনা ও ঝুঁকি কমাতে হলে বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এতে ছোট গাড়ি কমবে, চালক কমবে এবং বিপরীতে বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে। গণপরিবহন বাড়লে, ছোট গাড়ির সংখ্যা কমবে। এতে সড়কে বাসের গতি বাড়বে এবং যাত্রীরাও স্বস্তি পাবে।
প্রতিবেশীসহ বিশ্বের কোনো দেশেই রাজধানীসহ বড় শহরে এভাবে ব্যাটারি রিকশার মহামারি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সবচেয়ে অন্তরায়। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আমলে নিতে হবে। বৈধ গাড়ির চলাচল এবং অবৈধ গাড়ি বন্ধ নিশ্চিত করাই হলো কার্যকর উপায়। একই সঙ্গে বৈধ ও অবৈধ গাড়ি চলাচল করতে পারে না, তাহলে আইন-কানুন বলে কিছু থাকে না।
এক সময় প্যাডেল রিকশা নিয়ন্ত্রণে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, ঢাকায় ৮০ হাজার দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা তো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এখন ব্যাটারি রিকশাও এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, তাতে আরো দুর্নীতি-অনিয়ম বাড়বে। রিকশাও প্রধান সড়কে চলার কথা না, কিন্তু চলছে। ব্যাটারি রিকশাও অলিগলিতে চলাচলের অনুমতি থাকলে একই অবস্থা হবে। ঢাকার মতো পাশের দেশ ভারতের কলকাতার প্রধান সড়ক থেকে রিকশা তুলে দিতে দুই বছর লেগেছে। শ্রমিকবান্ধব বাম সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে সমস্যা না হলে ঢাকায় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা কোথায়?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারতসহ একাধিক দেশ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও এর যন্ত্রাংশ অবাধে আমদানি করার সুযোগ দেওয়া হয়। স্থানীয় গ্যারেজে দেশীয়ভাবে সহজে তৈরি করে বিনা কাগজপত্রে বাধাহীনভাবে রাস্তায় নামানো হয়েছে এসব রিকশা।
এভাবে লাখ লাখ ব্যাটারি রিকশা রাস্তায় নামে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এতে চলাচল করা যাত্রীদের যেমন জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, তেমনই চালকদেরও রয়েছে। এর কারণে অন্যান্য যানবাহনেরও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে, যানজট বেড়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন সবাই।
বিষয়টি নিয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ব্যাটারি রিকশা যেভাবে বেড়েছে, তা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। এই ধরনের যানের সংখ্যা, রাস্তায় চলাচল, অবৈধভাবে তৈরি হওয়া, চার্জ দেওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মূল সড়কে নয়, গলির রাস্তায় চলতে পারে, সেটাও একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায়। এটি এক লাখের কম-বেশি হতে পারে।
রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়, সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা চলবে না। আমরাও প্রধান সড়কে এই রিকশা চলাচলের পক্ষে না। অলিগলিতে চলবে। এটি নিয়ে একটি নীতিমালা করে নিয়ন্ত্রণ করা হোক। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করুক।
বিশেষজ্ঞদের মত, শ্রমজীবীদের একটি বড় অংশ এখন ব্যাটারি রিকশা চালাচ্ছেন। এতে কৃষিখাতসহ বিভিন্ন খাতে শ্রমিক সংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে উৎপাদন কমছে, দ্রব্যমূল্যের দামও বাড়ছে। আবার দুর্ঘটনার কারণে অনেক কর্মক্ষম তরুণের স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং অঙ্গহানি ঘটছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর বিষয়ে কখনও কোনো কথা হয়নি। ইজিবাইকের কাঠামোগত কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিল বুয়েট। বিআরটিএর কাছে প্রস্তাবও জমা দিয়েছে বুয়েট। এরপর বিষয়টি আর সামনে এগোয়নি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)’র অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সারওয়ার বলেন, ব্যাটারি চালিত অটো রিকশার ব্যাপারে একটি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। শিগগিরই নীতমালা পাস হলে সড়কে ব্যাটারিচারিত অটো রিকশার বিষয়ে একটি সুশৃঙ্খল পরিস্থিতি ফিরে আসবে বলে আশা করছি। বর্তমানে ট্রাফিক বিভাগ কাজ করছে, যাতে প্রধান সড়কগুলোতে অটো রিকশাগুলো চলাচল করতে না পারে।
ফজর | ০৪:৫৪-০৬:০৮ মিনিট ভোর |
---|---|
যোহর | ১২:০৯-০৪:২৫ মিনিট দুপুর |
আছর | ০৪:২৬-০৬:০৬ মিনিট বিকাল |
মাগরিব | ০৬:১০-০৭:২১ মিনিট সন্ধ্যা |
এশা | ০৭:২২-০৮:৪৯ মিনিট রাত |
জুম্মা | ১.৩০ মিনিট দুপুর |