তেহরানে ইসরাইলের আক্রমণ কেবল সামরিক ঘাঁটি এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি বরং সাধারণ নাগরিকদের জীবনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। যুদ্ধের আঁচ গিয়ে লেগেছে তাদের শোবার ঘর, রান্নাঘর এবং বসার ঘরেও। অনেক শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। অনেক শিক্ষকের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেছে, ক্রীড়াবিদরা চাপা পড়েছেন ধ্বংসস্তূপের নিচে। তারা সকলেই রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে ছিলেন। ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে গত শুক্রবার ইসরাইল ইরানের এক ডজনেরও বেশি স্থাপনা লক্ষ্য করে আগাম বিমান হামলা শুরু করে। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা বিধস্ত হবার পাশাপাশি এর পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং সামরিক নেতারাও নিহত হন। ইরানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ২২৪ জন নিহত এবং ১,৪৮১ জন আহত হয়েছেন।
ইরান ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে প্রতিশোধ নিয়েছে, যার ফলে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত এবং ৩৮০ জন আহত হয়েছে। সেইসঙ্গে আরও বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে। তেহরানে, ধ্বংসের পুরো চিত্র এখনও দেখা বাকি। রাস্তাঘাটে, বোমা বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাণহানির প্রমাণ সামনে আসছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে উঁকি মারছে শিশুর প্রাণহীন দেহ। রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ধুলোয় ঢাকা পুতুল। কংক্রিট এবং ধুলোর মধ্যে চাপা পড়েছে একরত্তির স্কেচবুক।
অনেক ইরানিদের কাছে, এই দৃশ্যগুলো ইরান-ইরাক যুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। কিন্তু এবার যুদ্ধটি সীমান্তে নয়; এটি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে। বাসিন্দারা বলছেন যে, তেহরানের রাতের আকাশ-এখন ক্ষেপণাস্ত্র এবং আগুনে ভরা- যা তারা আগে কখনো দেখেননি। ব্যাপক আতঙ্কের মধ্যে, মানুষ দলে দলে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। পেট্রোল পাম্পগুলোতে ভিড়। মহাসড়কগুলোয় দেখা যাচ্ছে ট্রাফিক জ্যাম। তেহরানে সাম্প্রতিক হামলায় নিহতদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে তুলে ধরা হলো ।
পাইলেটস প্রশিক্ষক
তেহরানে এখন শুধু ধুলো আর ধোঁয়ার গন্ধ। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রর আঘাতে বাড়িগুলো ভেঙে পড়ার পর নীরব কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটি ছিল নিলুফার ঘালেহভান্দের। যার বন্ধু গজল, বোমা পড়ার ঠিক আগের রাতে শেষবারের মতো নিলুফারকে একটি ক্যাফেতে কফি খেতে দেখেছিলেন। ৩২ বছর বয়সী পাইলেটস প্রশিক্ষক ঘালেহভান্দকে তার বাবা কামরান ঘালেহভান্দ এবং তার মা ফাতেমেহ সেদিঘির সাথে উত্তর তেহরানের ওজগোল স্ট্রিটে তাদের বাড়িতে হত্যা করা হয়েছিল। গজল আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা ক্যাফেতে কফি খাচ্ছিলাম, সে কফি খেতে খেতে আমাকে বলেছিলো ইরান খুব সুন্দর। আমি চাই আমরাও যাতে অন্যান্য দেশের মানুষের মতো শান্তিতে থাকতে পারি। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে, নিলুফার চলে গেছে। আমরা ২৮শে জুন তার ৩২তম জন্মদিন উদযাপনের পরিকল্পনা করছিলাম।’
গজল বলেন, ঘালেহভান্দ ইরানের সর্বোচ্চ পদস্থ সামরিক কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরির বাসভবনের কাছে থাকতেন, যাকে টার্গেট করা হয়েছিল। নিলুফারের পরিবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে গজল বলেন, তারা সাধারণ মানুষ ছিল, কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না।
নিলুফার ঘালেহভান্দ একজন বিখ্যাত পাইলেটস প্রশিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
ক্রীড়াবিদ
শুক্রবার সকালে ২৭ বছর বয়সী পেশাদার প্যাডেল টেনিস খেলোয়াড় পারসা মনসুর, উত্তর তেহরানের ঘনবসতিপূর্ণ জেলা শাহরারা থাকতেন। যখন তার বাড়ির কাছাকাছি একটি ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে তখন তিনি তার বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণে জানালার কাঁচ ভেঙে যায় এবং ধ্বংসাবশেষ তার উপর এসে পড়ে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় মনসুরের। পাশের ঘরে থাকা তার বাবা-মা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু সামান বলছেন, ‘পারসা হাসিখুশি থাকত এবং সবসময় রসিকতা করত। পারসা দক্ষ ক্রীড়াবিদ ছিল কোচ ছাড়া একাই প্রশিক্ষণ নিতো। যখন আমি টেনিস ফেডারেশনে তার মৃত্যুর ঘোষণাটি দেখি, তখন আমি হতবাক হয়ে যাই। প্রথমে আমি বিশ্বাস করিনি। তারপর আমি তার বাড়িতে যাই। পারসার গোটা বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।’
পারসার বাবার মনের অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তার ছেলে আর নেই।
যে ছেলে তার বাবাকে হারিয়েছে
রবিবার বিকেলে ৩০ বছর বয়সী তায়কোয়ান্ডো ক্রীড়াবিদ আমিন আহমেদ পূর্ব তেহরানে তার বাবার ভয়াবহ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন। আহমেদ বলেন, ‘বিস্ফোরণে আমার বাবা বাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তার মুখ পুড়ে গিয়েছিল।’ বাবার শেষ মুহূর্তগুলোর কথা মনে করতে করতে আহমেদের গলা কেঁপে আসছিলো। তিনি বলেন, ‘আমরা ভেতরে আটকা পড়েছিলাম। আমি জোর করে জানালা খুলে সাহায্যের জন্য ডাকতে থাকি। কেউ একজন মই এনে আমাকে আর আমার মাকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল। আমার বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে এই বাড়িটি কিনেছিলেন, যাতে তিনি শান্তিতে অবসর নিতে পারেন। এখন তিনি মারা গেছেন এবং বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে। তার অপরাধ কী ছিল? আমি জানি না এখন কী করব।’
ফটোগ্রাফার
রবিবার দুপুরে দুই রাত ধরে ইরানের আকাশসীমায় ইসরাইলি যুদ্ধবিমানের আওয়াজের পর উত্তর তেহরানের তুলনামূলকভাবে ধনী এলাকা তাজরিশে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। পানির পাইপ ফেটে যায়, রাস্তাগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। ৩৫ বছর বয়সী ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার এবং গ্রাফিক ডিজাইনার এহসান বায়রামি সেইসময় ঘটনাস্থল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণের জেরে তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হয়। তার সহকর্মী আলী বলছেন, বায়রামি সবেমাত্র একটি কাজ সেরে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি স্পোর্টস ক্লাবের জন্য ভিডিও করতেন এবং ক্রীড়া ইভেন্টের ছবি তুলতেন। রবিবার সকালেও বায়রামিকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন আলী। তার কথায়, ‘বায়রামি আমাকে বলেছিল চিন্তা করো না কারণ দিনের বেলায় এই অঞ্চল নিরাপদ। ইসরাইল কেবল রাতে আক্রমণ করে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে।’
আলী খানিকটা থেমে যোগ করেন, ‘এহসান অসাধারণ প্রতিভাবান এবং পরিশ্রমী ছিল। কোনও কিছুই তাকে কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি।’
সূত্র : আলজাজিরা
ফজর | ০৪:৫৪-০৬:০৮ মিনিট ভোর |
---|---|
যোহর | ১২:০৯-০৪:২৫ মিনিট দুপুর |
আছর | ০৪:২৬-০৬:০৬ মিনিট বিকাল |
মাগরিব | ০৬:১০-০৭:২১ মিনিট সন্ধ্যা |
এশা | ০৭:২২-০৮:৪৯ মিনিট রাত |
জুম্মা | ১.৩০ মিনিট দুপুর |