| ২১ জুন ২০২৫


দক্ষিণ এশিয়া : যুদ্ধ-প্রযুক্তি পরীক্ষার ময়দান

রিপোর্টারের নামঃ ডেস্ক নিউজ
  • আপডেট টাইম : 11-06-2025 ইং
  • 9727 বার পঠিত
দক্ষিণ এশিয়া : যুদ্ধ-প্রযুক্তি পরীক্ষার ময়দান
ছবির ক্যাপশন: দক্ষিণ এশিয়া : যুদ্ধ-প্রযুক্তি পরীক্ষার ময়দান

দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই উত্তপ্ত। পারমাণবিক শক্তিধর চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। সর্বশেষ ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর নৃশংস হামলার পর উভয় দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পাল্টাপাল্টি ব্যাপক হামলার পর অবশ্য যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছে দেশ দুটি।

পেহেলগামের হামলা ভারতেরই সাজানো নাটক, নাকি প্রকৃতই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, তা এখনো তদন্তসাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম এই হামলা নিয়ে পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা শুরু করে। পাকিস্তানে ভারতের হামলার বৈধতা দিতে গিয়ে তারা বলছে, পেহেলগামের অস্ত্রধারীরা পাকিস্তানের মদতপুষ্ট।

পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, তুরস্ক, কাতার, ইরান এবং সৌদি আরব পেহেলগাম হামলার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানালেও ভারতীয় মিডিয়া আর রাজনীতিবিদরা সেই আহ্বান উপেক্ষা করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে থাকে। এতে উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হয়। এরপর দেশ দুটি কোনো ধরনের একটা যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছালেও পরস্পরের বিরুদ্ধে তারা যেভাবে শর্তভঙ্গের অভিযোগ আনছে, তাতে আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে।

এই জটিল সন্ধিক্ষণে দেখার বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়া কীভাবে পরাশক্তিগুলোর প্রযুক্তিযুদ্ধের মঞ্চে পরিণত হচ্ছে। আর যুদ্ধ যদি আবার শুরু হয়, তাহলে ঘটনা যেকোনো দিকে গড়াতে পারে। তবে, দুটি বিষয় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। একটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া কীভাবে পরাশক্তিগুলোর প্রযুক্তিযুদ্ধের মঞ্চে পরিণত হয়ে গেল। অন্যটি হলোÑভবিষ্যতে যদি যুদ্ধ বাধে, তাহলে এর পরিণতি কী হতে পারে। পরাশক্তিগুলো কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে উভয় পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থেকে আলোচনার টেবিলে বসবে?

প্রশ্ন হচ্ছেÑএই যুদ্ধটা আসলে কাদের মধ্যে হচ্ছে? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যেসব পরাশক্তি ভারত ও পাকিস্তানকে সহায়তা করছে, তারা এ অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বিস্তার পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির জন্যই এসব করছে না। তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধে একে অন্যের ওপর আধিপত্যও কায়েম করতে চায়।

পুরোনো আমলের যুদ্ধের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বর্তমানে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মাইক্রোওয়েভ অস্ত্র থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ থেকে শুরু করে সাইবার যুদ্ধÑসবই চলছে। এই প্রযুক্তি বিপ্লবের উদ্দেশ্যÑনতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নিজেদের এগিয়ে রাখা। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা জমে উঠেছে। আজ যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ছাড়িয়ে যায়, তো কাল চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায়।

একজন শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সেথ জি. জোন্স তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, চীন এবং আমেরিকা উভয়ই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পেছনে আমেরিকা যেখানে বছরে ২৪ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, সেখানে চীনের ব্যয় ৩১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার।

পাকিস্তান-ভারতের সাম্প্রতিক যুদ্ধে দুই পরাশক্তি চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা চোখে পড়ার মতো। এই যুদ্ধে চীনের কাছে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা পরাজিত হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

নিরপেক্ষ গবেষক, প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং শীর্ষস্থানীয় মিডিয়া হাউসগুলো শত শত প্রমাণ করে দেখিয়েছে কীভাবে চীনা প্রযুক্তি পশ্চিমা এবং ইসরাইলি ড্রোন, জেট, রাডার এবং জ্যামারগুলো অকেজো করে দিয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক জারার খুহরোর মতে, পাকিস্তানে ভারতের বিমান হামলা পুরোপুরি বুমেরাং হয়েছে। বিমান ও ড্রোনযুদ্ধে চীনা প্রযুক্তি দারুণ সক্ষমতা দেখিয়েছে। সিএনএন বলেছিল, এই সংঘাত চীনের জন্য প্রথম বড় কোনো পরীক্ষা। এরপর বিশ্ব দেখল, চীনা সমর প্রযুক্তি পাশ্চাত্যের বহু পরীক্ষিত অস্ত্রগুলো কীভাবে টেক্কা দিল।

মেহুল শ্রীবাস্তব এবং চার্লস ক্লোভারসহ বহু সামরিক বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তানের সর্বশেষ যুদ্ধটি শুরুর আগ থেকেই চীনের চেংডু এয়ারক্রাফট কোম্পানিতে জেএফ-১৭ থান্ডার এবং জে-১০ ভিগোরাস ড্রাগন যুদ্ধ বিমানের মজুত হুহু করে বাড়তে শুরু করেছিল। পশ্চিমা গণমাধ্যম, প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদরা স্বীকার করছেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চীনা অস্ত্রগুলোর সক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের আস্থা বেড়ে গেছে। বিশ্ব বুঝতে পারছে, চীনা প্রযুক্তি পশ্চিমা প্রযুক্তিকে টেক্কা দিতে পারে। কারণ চীনের জে-১০-সি ভিগোরাস ড্রাগন যুদ্ধবিমান এবং পিএল ১৫ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েই ফ্রান্সের রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তান।

স্টেলথ বিমান তৈরিতেও চীন অনেক এগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জে-২০ সিরিজের যুদ্ধ বিমানগুলোর নাম বলতেই হয়। এই সিরিজের ষষ্ঠ প্রজন্মের বিমান জে-৩৬ বিমানগুলো আকাশ যুদ্ধে খুবই কার্যকর। এটি এক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমেরিকার গুয়াম বিমানঘাঁটির আকাশসীমাকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত অকার্যকর করে রাখতে পারে। একইভাবে, নৌ ও বাণিজ্যিক জাহাজ উৎপাদনেও চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে আছে। ব্রুকিং ইনস্টিটিউটের একটি রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছে, চীন খুব দ্রুত গতিতে পাশ্চাত্য নৌশক্তিকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী এই যুদ্ধে নিঃসন্দেহে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে, কিন্তু এই যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার আকাশযুদ্ধের ভরকেন্দ্র বদলে দিয়েছে। এখন আকাশযুদ্ধের ময়দানে চীন একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

টিআরটির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত তার যুদ্ধের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইসরাইলি প্রযুক্তির পেছনে অনেক টাকা ঢেলেছে। দেশটি ইসরাইলের কাছ আধুনিক প্রযুক্তির অনেক সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। গত মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে হারতে হয়েছে ভারতকে। এ ছাড়া এই যুদ্ধের ফলে দক্ষিণ এশিয়াকে কেন্দ্র করে নতুন ধরনের ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে। চীন, তুরস্ক, আজারবাইজান, সৌদি আরব এবং ইরান পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে তুরস্কের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কানের উৎপাদনে পাকিস্তান কৌশলগত অংশীদার হয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুরস্ক ও পাকিস্তান আরো কাছাকাছি চলে এসেছে।

আশা করা যায়, পরিস্থিতি একবার শান্ত হয়ে গেলে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই সংলাপের টেবিলে বসবে। কিন্তু ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন-তাইওয়ানসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে আমরা হয়তো এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেখতে পাব, যেখানে মূলত চীন ও পাশ্চাত্য প্রযুক্তির মধ্যে আকাশযুদ্ধ হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এটা একটা বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
নামাজের সময়সূচী
জাতীয় সঙ্গীত
©সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ Gen Z Bangladesh Online - জেন জি বাংলাদেশ অনলাইন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ