| ০৭ জুন ২০২৫

আল জাজিরার প্রতিবেদন: কোন ভয়ে ট্যাটু মুছে ফেলছেন কাশ্মীরি তরুণরা

রিপোর্টারের নামঃ ডেস্ক নিউজ
  • আপডেট টাইম : 20-05-2025 ইং
  • 17009 বার পঠিত
আল জাজিরার প্রতিবেদন: কোন ভয়ে ট্যাটু মুছে ফেলছেন কাশ্মীরি তরুণরা
ছবির ক্যাপশন: আল জাজিরার প্রতিবেদন: কোন ভয়ে ট্যাটু মুছে ফেলছেন কাশ্মীরি তরুণরা

বারামুল্লার ইরফান ইয়াকুব বলেন, ‘এক সময় একটা বিদ্রোহীর নাম ছিল হাতে। এখন মনে হয় আমি অনেক বদলে গেছি। পরিবার, চাকরি, ভবিষ্যতের চিন্তা—এসব মাথায় রেখে পুরনো চিহ্ন মুছে ফেলাই ভালো।‘

কাশ্মীরের শ্রীনগরের এক নিরিবিলি লেজার ক্লিনিকে চুপচাপ বসে আছেন ২৮ বছরের সামীর ওয়ানি। তার বাহুর ওপর লেজারের আলো পড়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে একটি শব্দ— ‘আজাদি’। উর্দু ভাষায় যার অর্থ স্বাধীনতা, এক সময় যা ছিল ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক, আজ তা তার জন্য হয়ে উঠেছে ভয় আর ঝুঁকির কারণ।

‘একবার মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলাম বন্ধুর সঙ্গে, চেকপয়েন্টে ভারতীয় বাহিনী থামিয়ে তল্লাশি চালায়। একজন জিজ্ঞেস করে, এটা কী লেখা তোমার হাতে? ভাগ্যিস তিনি উর্দু পড়তে পারতেন না,’ বলেন সামীর। তখনই বুঝে গিয়েছিলেন, এই ট্যাটু তার জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।

কিন্তু এক সময় এই ট্যাটুই ছিল তার সাহসের পরিচয়। এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতীতের এক ছায়া, যা তার ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

কাশ্মীরে এখন অনেক তরুণই তাদের রাজনৈতিক প্রতীকী বা ধর্মীয় ট্যাটু গোপনে মুছে ফেলছেন। কেউ করছেন নিরাপত্তার কারণে, কেউ ধর্মীয় উপলব্ধিতে, কেউ বা চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কায়। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে পেহেলগামে সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনার প্রেক্ষিতে এই প্রবণতা আরো বেড়েছে।

৭ মে’তে ভারত ‘জঙ্গি ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে পাকিস্তান ও পাক-শাসিত কাশ্মীরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়— যা ছিল ১৯৭১ সালের পর সবচেয়ে বড় সীমান্ত আঘাত। এর ফলে কয়েক দিনের মধ্যে উভয় দেশের মধ্যে চলে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি। অবশেষে ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়। কিন্তু ভারত-শাসিত কাশ্মীরে সেই উত্তেজনার রেশ থেকে গেছে। ব্যাপক ধরপাকড়, চিহ্নিত ঘরবাড়ি ধ্বংস, এবং ১,৫০০’র বেশি গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে সেখানে তৈরি হয়েছে এক নিঃশব্দ আতঙ্ক।

শোপিয়ানের বাসিন্দা ২৬ বছরের রইস ওয়ানি বলেন, ‘আমার হাতে হুররিয়তের নেতা গিলানির নাম খোদাই করা ছিল। হামলার পর চেকপয়েন্টে লোকজন কেমন যেন দৃষ্টি দেয়, এমনকি বন্ধুরাও প্রশ্ন করে বসে।‘

একই অভিজ্ঞতার কথা বলেন পুলওয়ামার ১৯ বছর বয়সী আর্সলান। তিনি নিজের ট্যাটু মুছে ফেলার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করে ফেলেছেন। তার ভাষায়, ‘পুরনো রাজনৈতিক ট্যাটু থাকলে এখন সবাই ভয়ে থাকে—কখন যেন প্রোফাইল করা হয়, জিজ্ঞাসাবাদ হয়, কিংবা আরো খারাপ কিছু।‘

কাশ্মীরে এখনো ট্যাটু জনপ্রিয়। স্টুডিওগুলোতে তরুণ-তরুণীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন ট্যাটু করাতে। তবে এখন পছন্দের তালিকায় এসেছে প্রকৃতিপ্রবণ ডিজাইন, ব্যক্তিগত উদ্ধৃতি, স্টাইলিশ ফন্টে নাম ইত্যাদি। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বার্তা হ্রাস পাচ্ছে।

বারামুল্লার ইরফান ইয়াকুব বলেন, ‘এক সময় একটা বিদ্রোহীর নাম ছিল হাতে। এখন মনে হয় আমি অনেক বদলে গেছি। পরিবার, চাকরি, ভবিষ্যতের চিন্তা—এসব মাথায় রেখে পুরনো চিহ্ন মুছে ফেলাই ভালো।‘

অনেকে ট্যাটু মুছে ফেলছেন ধর্মীয় উপলব্ধিতে। কেউ আবার পরিবার বা কর্মক্ষেত্রে সমস্যার ভয়ে। যেমন শ্রীনগরের আনাস মীর বলেন, ‘আমি স্বাধীনতা লেখা তলোয়ার আঁকিয়েছিলাম হাতে। পরে পরিবারের চাপে মুছে ফেলি। কারো ট্যাটু দেখে তাকে বিচার করা উচিত না।‘

ফাহিম নামে আরেক তরুণ কুরআনের আয়াত খোদাই করেছিলেন পিঠে। এখন সেটা তার নামাজে বাধা মনে হয়। ‘এটা ছিল আমার ভুল বোঝা বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। এখন তা সংশোধন করছি,’ বলেন তিনি।

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও ট্যাটু সমস্যা তৈরি করতে পারে। ২৫ বছর বয়সী তালিব বলেন, ‘একবার চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম। পুলিশে কাজ করা এক আত্মীয় অল্প কথায় বুঝিয়ে দেন ট্যাটুটা সমস্যা হতে পারে।‘

শ্রীনগরের জনপ্রিয় ট্যাটু আর্টিস্ট ও রিমুভাল বিশেষজ্ঞ মুবারক বাশির বলেন, ২০১৯ সালের পর থেকে হাজারে হাজারে মানুষ ট্যাটু সরিয়েছেন। পেহেলগামের হামলার পর এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। লেজার সেশন ব্যয়বহুল, বেদনাদায়ক এবং সময়সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রেই দাগ থেকে যায়। তবু তরুণদের জন্য এই ত্যাগ এখন প্রয়োজনীয় বলেই মনে হচ্ছে।

সামীর বলেন, ‘ট্যাটু করানোর সময় কাঁদিনি, কিন্তু যখন মুছাতে শুরু করলাম চোখ ভিজে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল নিজের এক টুকরোকে বিদায় দিচ্ছি।‘

শেষ লেজার সেশনের পর তার বাহুতে ‘আজাদি’ শব্দটি আর নেই। শুধু হালকা একটা দাগ। সামীর বলেন, ‘১৮ বছর বয়সে এর মানে ছিল একরকম। কিন্তু এখন আমি নতুন করে বাঁচতে চাই। ছায়া ছাড়া এক জীবন।‘

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
নামাজের সময়সূচী
জাতীয় সঙ্গীত
©সকল কিছুর স্বত্বাধিকারঃ Gen Z Bangladesh Online - জেন জি বাংলাদেশ অনলাইন | আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ