বিশেষ প্রতিনিধি, বিশেষ প্রতিনিধি।।
ডেস্ক নিউজ:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘সম্প্রচার আইন ২০১৮’ এর খসড়া চূড়ান্ত করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। প্রস্তাবিত সেই আইনে ‘অনলাইন নিউজ পোর্টাল’, ‘রেডিও’, ‘টেলিভিশন’ এবং মাল্টিমিডিয়া-ভিত্তিক ‘সম্প্রচার প্ল্যাটফর্ম’ নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরের কারাদ- এবং ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার একটি প্রস্তাবনা ছিল। এবার সেই ধারাসহ বেশ কয়েকটি সংশোধনী এনে নতুন অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এই সংশোধনীতে ৭ বছরের পরিবর্তে সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদন্ড আর ৫০ কোটি টাকার পরিবর্তে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। অধ্যাদেশটি বাস্তবায়ন করতে গত ২১ এপ্রিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে নতুন প্রস্তাবিত খসড়া অধ্যাদেশটি মতামতের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত ৯ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবা ফারজানার সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় নতুন খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়।
খসড়ার বিভিন্ন ধারার মাধ্যমে গণমাধ্যমের জন্য কোনো ভয়ের কারণ আছে কি না জানতে চাইলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফারাহ শাম্মী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০১৮ সালের আইনের খসড়া সম্পর্কে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছে। তাদের মতামত পাওয়ার পর, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করে খসড়াটি সংশোধন ও চূড়ান্ত করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘খসড়ার বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের জন্য কারাদ- এবং জরিমানার বিধানগুলো বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত হবে। এসব চূড়ান্ত করার সময় অংশীজন হিসেবে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মতামত বিবেচনা করা হবে।’
২০১৪ সালে জাতীয় সম্প্রচার নীতি প্রকাশ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সে সময় নীতিটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক এবং সমালোচনা হয়। এরপর সরকার বলেছিল, নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হবে। এই উদ্দেশ্যে ৪০ সদস্যের একটি কমিটি গঠনও করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর জনমতের জন্য আইনের একটি খসড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে ১৫ অক্টোবর তৎকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা খসড়াটি অনুমোদনও দেয়। এতে বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদন্ড এবং ৫০ কোটি টাকা জরিমানার বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব), সম্পাদক পরিষদ এবং অন্যান্য সাংবাদিক সংগঠনের আপত্তির কারণে খসড়াটি বিল হিসেবে সংসদে উপস্থাপন করা হয়নি।
সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিক্রিয়ার জন্য পাঠানো খসড়া অধ্যাদেশে ধারা ২৭(৪) এ বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো সম্প্রচার বা অনলাইন মিডিয়া সংস্থা গোপনীয় সামরিক বা বেসামরিক তথ্য বা উপকরণ প্রচার করে যা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করতে পারে, তাহলে এই ধরনের সম্প্রচার কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিকে ৫ বছরের কারাদন্ড বা কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা এবং অনধিক ৫০ লাখ টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।’
ধারা ২৭(২)-এ বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো সম্প্রচার বা অনলাইন মিডিয়া সংস্থা রাষ্ট্র বা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে এমন বিষয়বস্তু, অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার করে, তাহলে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিকে ৩ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।’
খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যদি কোনো সম্প্রচার বা অনলাইন গণমাধ্যম সংস্থা জাতীয় বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তিকে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যেতে পারে।
যদি কোনো সম্প্রচার বা অনলাইন গণমাধ্যম সংস্থা লাইসেন্স ছাড়া কাজ করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তিকে ৩ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, যদি কোনো সম্প্রচার বা অনলাইন গণমাধ্যম সংস্থা অননুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জুয়া, তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য, অ্যালকোহল, অথবা ধর্মীয়ভাবে শোষণমূলক, বিভ্রান্তিকর বা প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করে, তাহলে বিজ্ঞাপনদাতা এবং সম্প্রচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি উভয়কেই ৩ বছরের কারাদন্ড বা ৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।
এছাড়া জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, আদালত বা আদালতের কার্যক্রম, সেনানিবাস বা কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই)-এর মতো বিজ্ঞাপনে জাতীয় ল্যান্ডমার্ক বা সুযোগ-সুবিধা প্রদর্শন করলে জড়িতদের ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
খসড়া আইন বাস্তবায়নে সরকার একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা কমিশন যদি বিশ্বাস করে কোনো সম্প্রচারক বা নিবন্ধিত সংস্থা এমন বিষয়বস্তু সম্প্রচার করছে যা জাতীয় নিরাপত্তা বা অখন্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ, সন্ত্রাসবাদ, নাশকতা বা সহিংসতাকে উৎসাহিত করতে পারে, বা জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করতে পারে, অথবা যদি তা অশ্লীল, মিথ্যা বা ঘৃণা উসকে দেয়, তাহলে কমিশন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদানের পর সরকারের কাছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, এই আইনের অধীনে অপরাধের বিচারের জন্য সরকার কর্তৃক এক বা একাধিক ‘সম্প্রচার ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই ট্রাইব্যুনালে জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারক নিয়োগ করা হবে। মামলার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
ফৌজদারি কার্যবিধি বা অন্য কোনো বিদ্যমান আইন যাই হোক না কেন, কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন না। অভিযোগের সঙ্গে কমিশনের অনুমোদনের একটি অনুলিপি জমা দিতে হবে।
অভিযোগ দায়েরের পর, ট্রাইব্যুনাল যদি পর্যাপ্ত কারণ না পায় তবে তা খারিজ করতে পারে। যদি তা করে, তাহলে ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য কোনো অনুমোদিত ব্যক্তির দ্বারা তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে।
তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। তদন্ত চলাকালে, কর্মকর্তা গ্রেপ্তার ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। যদি সময়মতো তদন্ত সম্পন্ন না হয়, তাহলে সময়সীমা সর্বোচ্চ ১৫ দিন বাড়ানো যেতে পারে। তারপরেও তদন্ত সম্পন্ন করতে ব্যর্থতা অবহেলা বলে বিবেচিত হবে এবং ট্রাইব্যুনাল তদন্তকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারে।
ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছু লেখা আছে তা সত্ত্বেও এই আইন এবং এর নিয়ম ও বিধির অধীনে সমস্ত অপরাধ অ-আমলযোগ্য এবং জামিনযোগ্য হবে।
খসড়া অনুযায়ী, অভিযোগ গঠনের তারিখ থেকে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাইব্যুনালকে বিচার শেষ করতে হবে, ফৌজদারি কার্যবিধির ২৩ অধ্যায়ের অধীনে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি না হলে, বিচারককে হাইকোর্ট বিভাগে কারণ জানাতে হবে এবং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করা যেতে পারে।
সম্প্রচার বা অনলাইন মিডিয়া সংস্থাগুলোকে লাইসেন্স বা নিবন্ধন প্রদানের আগে, কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করতে হবে। কোনো মিডিয়া সংস্থা লাইসেন্স বা নিবন্ধন ছাড়া কাজ করতে পারবে না। তবে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইতিমধ্যে অনুমোদিত রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলের মতো মিডিয়া আউটলেটগুলো এই আইনের অধীনে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা নিবন্ধিত বলে বিবেচিত হবে, যা নবায়ন সাপেক্ষে বিবেচিত হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, সম্প্রচার লাইসেন্সধারী কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা কার্যক্রম শুরু করার আগে বা কার্যক্রম শুরু করার দুই বছরের মধ্যে মালিকানা হস্তান্তর করতে পারবে না। দুই বছর পর, হস্তান্তরিত মালিকানা কোনো অবস্থাতেই ৪৯ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।